উত্তেজনা এবং তার শিকার

 

 আমার প্রিয় ছাদের ঘরটার সাথে আমাদের বাকি ঘরগুলোর কোনো সরাসরি যোগাযোগ নেই। একবার ওই ঘরে আসুন বুঝবেন বাইরের দুনিয়ার থেকে আপনি বেশকিছুটা দূরে এসে গিয়েছেন। এই ঘরটার একপাশে একটা খাটাল বেশ বেশকিছুটা জায়গা নিয়ে ওখানে থাকে অনেককটা মোষ আর দুটো গরু। মোষগুলো থাকে টিনের চলার নিচে আর গরুগুলো আর একটু আরামে খড়ের চলার বানানো সুন্দর গোয়ালঘরে। গরুগুলো দিনের বেলায় চরতে বের করলেও মোষগুলো সারাদিন আর রাত বন্দি থাকতো ওখানেই। ওরা লক্ষ্য করবেন খুব বেশি কমপ্লেন করেনা, গরুগুলো তবুও "হাম্বা হাম্বা" বলে প্রতীকী প্রতিবাদ করলেও কালো কালো মোষগুলো শুধু খড় আর ভুষি তেই তুষিয়ে যেত, ওরা স্পিকটিনট । আমাদের ঘরের অন্য দিকে আছে নীলিমা ঠাকুমাদের বাড়ি।ওদের বাড়ির ছাদটা আমাদের চেয়ে একটু বেশি উঁচু, ছাদ থাকলে যা হয় আরকি ওখানে ভেজা জামা, মোজা, গেঞ্জি শুকোনোর জন্যে প্রায় দেয়া হতো আর মাঝে মাঝে শাড়ি। এই হলো গল্পটার দিনের পরিবেশ ।

সামনে মাধ্যমিক রাতজেগে পড়াশুনো চলছে, একাকিত্ব আর নির্জনতার সন্ধানে আমি ছাদের ঘরে নিজেকে চালান করেছি একমাস হলো, আমি আজকে রাতে আর পড়তে পারছিনা ইতিহাস আমার একদম ভালো লাগেনা, ওটাকে রাত্রের জন্যে রেখে ভালো করিনি। আমি বরাবর বিছানাতে শুয়ে পড়াশুনো করি। কখন যে ঘুম এলো বুঝতেই পারলাম না।
এই হলো গিয়ে গল্পের শুরু।
একটা নদী ঠিক কাঁসাই এর মতন সরু স্রোতে বয়ে চলেছে তার একপাশে ধানক্ষেত এসব দেখতে দেখতে আমি আর সে হাতে হাত ধরে হাঁটছি, না এখনো একে মনের কথাটা বলা হয়নি, পকেট থেকে লাল গোলাপ ফুলটা বার করে হাঁটু গেড়ে সবে মাত্র প্রশ্নটা করতে যাবো অমনি "ক্ক...ক্ক..ক্ক ক্কড়াম " বিদ্যুত চমকালো। কিহবে আবার! স্বপ্ন গেলো টুটি, আমি বিছানায় হড়বড়িয়ে উঠে বসতে না বসতে । "ক্ক...ক্ক..ক্ক ক্কড়াম "। কি আপদ উপরওয়ালা মস্করা শুরু করেছে রাত্রে বেলায়, বেডল্যাম্প টা জ্বলালাম। এবারে শব্দ হলো আবার "ক্ক...ক্ক..ক্ক ক্কড়াম " সাথে সাথে "গেয়াওঁওঁ...গেয়াওঁওঁ...গেয়াওঁওঁ"। রেগে গিয়ে ঘরটার থেকে বাইরে বেরিয়েই, গেলো, গেলো, লোডশেডিং। বিজ্ঞানে বলে অন্ধকারে চোখ নিজেকে মানিয়ে নেয় কম আলোতে দেখার জন্যে কিন্তু এখানে চাঁদের আলোটাও নেই, ঘুটঘুটে অন্ধকার চোখটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। অদ্ভুত? বিদ্যুৎ বেশ কিছুক্ষন হলো আর চমকায় না। অন্ধকারে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এসব ভাবছি অমনি পেছন থেকে তীব্র ঠান্ডা হাওয়া এসে সামনে ছুটে বেরিয়ে গেলো, ঠান্ডা হওয়াটা এবারে যেন আমার সাথে ছোঁয়া ছুঁই খেলছে, মাঝে মাঝে এসে ছুঁয়ে যাচ্ছে আস্তে আস্তে ওটার সাথে "শোওঁওঁওঁ...শোওঁওঁওঁ..." আওয়াজ শুরু হয়েছে কিছুটা দূরে "খোঁচড় মোচোড় শব্দ ভেসে আসছে" খুব মনদিয়ে শুনলাম মনেহলো দেয়াল দিয়ে কেও ওঠার চেষ্টা করছে আলগা একটা "ঠোকা... ঠক..." শব্দও তালমিলিয়ে চলছে । এটুকু কি ভয় খাওয়ানোর জন্যে কম নাকি। আমি এবারে রীতিমতন ভয় খাচ্ছি, সামনে পেছনে দূরদূর শুধু অন্ধকার। বাকি অনেক কটা শব্দ অঙ্ক কোষে মিলিয়ে ফেললেও "গেয়াওঁওঁ..." এইটা আর "ঠোকা... ঠক..." মেলাতে পারিনা মানে অঙ্কের কোনো সমীকরণ মিলছেনা । তবে কি ভৌতিক সমীকরণ? আমিও ঠিক এটাই ভেবেছি কি ভাবিনি অমনি আকাশে বিদ্যুত ঝলসে উঠে সামনে দেখি নীলিমা ঠাম্মা দের ছাদে রোশনাই শাড়ি জড়িয়ে কেও দাঁড়িয়ে আছে, ছেলে কি মেয়ে জানি না কিন্তু বেশ রোগা, ঠিক ততটাই রোগা যতটা হলে মানুষ বাঁচে না, এবারে "ক্ক...ক্ক..ক্ক ক্কড়াম " ,"গেয়াওঁওঁ...গেয়াওঁওঁ...গেয়াওঁওঁ" আরো জোরে, "ঠোকা... ঠক..." শেষমেশ দমফাটা "গুড়ুম...গুড়ুম...গুম" নতুন সংযোজন শেষেরটা। ভয়ে নিচে পালিয়ে যাবো ঠিক করলাম, বরাত জোরে বিদ্যুতের আলোয় দেখতে পেয়েছি আমি সিঁড়ির দেয়াল এর কাছেই আছি। রীতিমতন কাঁপছি, হনুমান চল্লিশা পাঠ ঠাকুমা শিখিয়েছিলো ইতিহাসের স্মৃতি থেকে ওটাই জপ করছি তখন " ভূত পিশাচ নিকট নেহি আবে..."। কোনোরকমে দেয়াল ধরে সিঁড়ি, আর তার পরে অন্ধকারে বাবার রুমএ সটান বাবার বিছানায় বাবার পশে। আমার বাবা "কি? হলো কি তোর ?" । মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে "ভ..ভ.."। বাবা " ধুস, ঘুমিয়ে পড়"। আমিও মনকে বোঝাই "ধুর"|
সকাল হয়েছে রাত কাবার, ছাদের উপরে ইনস্পেকশন করতে গিয়েছি কতটা কি হয়েছে কালরাতে। নীলিমা ঠাম্মার ছাদে টুকি পিসি বলছে " মা..মা.. ও.. মা.. তোমার শাড়িটা কালকে নিয়ে যেতে ভুলে গেছিলে দেখো কি হয়েছে, ছাতের পাশের বাঁশে বাজে ভাবে জড়িয়ে আছে খুলতে পারছিনা।" । পাশের খাটালেও হল্লা, এটা আবার বিহারি ভাষায়, তাকিয়েদেখি, একটা মোষ নিজের উত্তেজনা চেপে রাখতে পারেনি বিদ্যুত এর উপদ্রপে আর তাতেই সে সিং মেরে টিনের চাল উল্টায় অতএব "গুড়ুম...গুড়ুম...গুম" এটা মিলে গেলো হিসেবে এখন। "এই মাইজি হো..এই মাইজি হো.. এই দুলারী কাহাঁ গিয়া।..দুলারী.. ও দুলারী" কিছুক্ষন পরে "দুলারী.. ইহান হায় কেও বলে"। দুলারী কে ধরে নিয়ে আসছে একজন, ওর গলায় দগদগে একটা ঘা, একটু রক্ত পড়ছে এটাও উত্তেজনার শিকার এর কেস দেখে মনে হলো উত্তেজনা সইতে না পেরে রেগে খুঁটি সমেত উপড়ে নিয়েছে। অতএব "ঠোকা... ঠক..." উপড়ানো খুঁটিটার শব্দ মাটিতে লেগে যেটা এখনো হচ্ছে বাহ্ এই তো মিলে গেলো , "গেয়াওঁওঁ...গেয়াওঁওঁ...গেয়াওঁওঁ" ওটা যন্ত্রণার শব্দ ওটা এখনো দুলারী গাইছে ওটাই যন্ত্রণার তাড়নায় (আজব সুর এই মোষগুলোর নোট করে রাখার মতন )। "খোঁচড় মোচোড়" দুলারী ধীরে সুস্থিরে ছাড়া পাওয়ার পরে পদচারণা করছিলো খাটালের থেকে একটু দূরে সেটার শব্দ।
সবটাই তো মিলিয়ে দিলাম, ভৌতিক সমীকরণ না ছাই এটাকে মিছিমিছি অশরীরীদের বদনাম দিতে নেই আমি জিভ কাটি ।

Comments

Popular posts from this blog

#321 Double Trouble

#325 Masterstroke of Time

#322 In Your Trance